ব্রণ কেন হয় এবং কী কী পরীক্ষা দরকার
ব্রণ (ইংরেজিতে Acne) হলো একটি সাধারণ ত্বকের সমস্যা। এটি তখন হয় যখন ত্বকের লোমকূপ তেল (সিবাম), মৃত কোষ এবং ব্যাকটেরিয়া দিয়ে বন্ধ হয়ে যায়। মুখ, ঘাড়, বুক, কাঁধ এবং পিঠে বেশি হয়, কারণ এই জায়গায় তেলের গ্রন্থি বেশি থাকে। ব্রণ সাধারণত কিশোর-কিশোরীদের হয়, তবে যেকোনো বয়সে হতে পারে।
কেন ব্রণ হয়:
- হরমোনের পরিবর্তন: কৈশোর, ঋতুস্রাব, গর্ভাবস্থা বা মেনোপজের সময় হরমোনের ওঠানামা তেল বেশি তৈরি করে। PCOS বা থাইরয়েড সমস্যাও ব্রণের কারণ হতে পারে।
- বেশি তেল তৈরি: ত্বকের তেল গ্রন্থি বেশি তেল তৈরি করলে লোমকূপ বন্ধ হয়।
- ব্যাকটেরিয়া: Propionibacterium acnes নামক ব্যাকটেরিয়া ব্রণের প্রদাহ বাড়ায়।
- মৃত ত্বকের কোষ: মৃত কোষ ঠিকমতো বের না হলে লোমকূপ বন্ধ হয়।
- খাবার: দুধ, চিনিযুক্ত খাবার বা ফাস্ট ফুড ব্রণ বাড়াতে পারে।
- মানসিক চাপ: স্ট্রেস তেল তৈরি বাড়িয়ে ব্রণ বাড়ায়।
- জিনগত কারণ: পরিবারে ব্রণের ইতিহাস থাকলে হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
- ওষুধ: কিছু ওষুধ (যেমন স্টেরয়েড) ব্রণ তৈরি করতে পারে।
- কসমেটিকস: তেলযুক্ত মেকআপ বা ক্রিম লোমকূপ বন্ধ করতে পারে।
ব্রণের প্রকার:
- ব্ল্যাকহেডস (খোলা লোমকূপ)
- হোয়াইটহেডস (বন্ধ লোমকূপ)
- প্যাপিউল (লাল ফুসকুড়ি)
- পাস্টুল (পুঁজ ভরা ফুসকুড়ি)
- নডিউল (শক্ত, বেদনাদায়ক গাঁট)
- সিস্ট (গভীর, পুঁজ ভরা ব্রণ)
কী কী পরীক্ষা দরকার: ব্রণ সাধারণত ত্বক দেখেই ধরা যায়। তবে গুরুতর ক্ষেত্রে নিচের পরীক্ষাগুলো হতে পারে:
- হরমোন পরীক্ষা: রক্ত পরীক্ষা করে হরমোনের মাত্রা (যেমন অ্যান্ড্রোজেন, থাইরয়েড) দেখা।
- ত্বকের পরীক্ষা: ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ ধরতে।
- রক্তে শর্করা পরীক্ষা: ডায়াবেটিস বা ইনসুলিন সমস্যা আছে কিনা দেখতে।
- অ্যালার্জি পরীক্ষা: খাবার বা পরিবেশের কারণ ধরতে। হোমিওপ্যাথির জন্য খাবার, মানসিক চাপ এবং ঋতুস্রাবের ইতিহাস জানা জরুরি।
ব্রণের লক্ষণ
- দেখা যায়:
- ব্ল্যাকহেডস (কালো বিন্দু)
- হোয়াইটহেডস (সাদা বিন্দু)
- লাল ফুসকুড়ি
- পুঁজ ভরা ব্রণ
- শক্ত, বেদনাদায়ক গাঁট
- গভীর, পুঁজ ভরা সিস্ট
- অন্যান্য লক্ষণ:
- ব্রণের চারপাশে লালভাব বা প্রদাহ
- ব্যথা বা স্পর্শে সংবেদনশীলতা
- চুলকানি বা জ্বালাপোড়া
- ত্বক তৈলাক্ত
- ব্রণ শুকিয়ে দাগ বা কালো দাগ
- মানসিক চাপ বা আত্মবিশ্বাস কমে যাওয়া
- ট্রিগার:
- ঋতুস্রাব, মানসিক চাপ বা দুধ-চিনির খাবারে ব্রণ বাড়ে।
- গরম বা আর্দ্র আবহাওয়া, তৈলাক্ত মেকআপে খারাপ হয়।
ব্রণের জন্য হোমিওপ্যাথি ওষুধ এবং তাদের ব্যবহার
নিচে ১০টি হোমিওপ্যাথি ওষুধের নাম, লক্ষণ এবং ব্যবহার দেওয়া হলো। হোমিওপ্যাথিতে রোগীর লক্ষণ ও শারীরিক গঠন অনুযায়ী ওষুধ দেওয়া হয়।
-
🧴 হেপার সালফ – পুঁজ ভরা সিস্টিক ব্রণের জন্য
এই ওষুধ পুঁজ ভরা ব্রণের জন্য খুব ভালো। ব্রণ বেদনাদায়ক, স্পর্শে সংবেদনশীল এবং পুঁজ বের হয়। কখনো পুঁজের সাথে রক্তও বের হতে পারে। ব্রণে ঝাঁঝালো বা খোঁচা ব্যথা থাকে। যারা ঠান্ডায় অস্বস্তি বোধ করে এবং রেগে যায়, তাদের জন্য এটি উপযুক্ত। এটি ব্রণ শুকিয়ে ব্যথা কমায়।কখন ব্যবহার করবেন?
পুঁজ ভরা, বেদনাদায়ক ব্রণ, যা ঠান্ডায় খারাপ হয়, তখন এটি ব্যবহার করুন।⏰ ডোজ:
৩০সি পাওয়ার দিনে একবার বা দুইবার, সমস্যার তীব্রতা অনুযায়ী। -
🧴 সালফার – চুলকানি ও লাল ব্রণের জন্য
সালফার তৈলাক্ত ত্বকের লাল, চুলকানি ব্রণের জন্য ভালো। ব্রণে জ্বালাপোড়া বা চুলকানি থাকে, যা আঁচড়ালে বাড়ে। রাতে বা গরমে ব্রণ খারাপ হয়। যারা মিষ্টি বা ঝাল খাবার পছন্দ করে এবং ত্বক নোংরা দেখায়, তাদের জন্য এটি উপযুক্ত।কখন ব্যবহার করবেন?
তৈলাক্ত ত্বকে লাল, চুলকানি ব্রণ, যা গরমে বা রাতে খারাপ হয়, তখন ব্যবহার করুন।⏰ ডোজ:
৩০সি পাওয়ার দিনে একবার বা দুইবার, ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে। -
🧴 পালসাটিলা – হরমোনজনিত ব্রণের জন্য (মেয়েদের)
মেয়েদের কৈশোর, ঋতুস্রাব বা গর্ভাবস্থায় হরমোনের কারণে ব্রণ হলে পালসাটিলা ভালো কাজ করে। তৈলাক্ত খাবারে ব্রণ বাড়ে। ব্রণে ব্যথা কম থাকে, তবে লালভাব থাকে। যারা আবেগপ্রবণ, কাঁদে এবং খোলা হাওয়ায় ভালো থাকে, তাদের জন্য উপযুক্ত।কখন ব্যবহার করবেন?
মেয়েদের হরমোনজনিত ব্রণ, বিশেষ করে ঋতুস্রাবের সময়, তখন এটি ব্যবহার করুন।⏰ ডোজ:
৩০সি পাওয়ার দিনে দুইবার, এক সপ্তাহ, বা ডাক্তারের পরামর্শে। -
🧴 কালি ব্রোমেটাম – মুখ, বুক ও কাঁধের ব্রণের জন্য
মুখ, বুক এবং কাঁধে পুঁজ ভরা বা শক্ত ব্রণের জন্য এটি ভালো। ব্রণ গভীর এবং দাগ ফেলে। মানসিক চাপে ব্রণ বাড়ে। যারা উদ্বিগ্ন বা অস্থির, তাদের জন্য উপযুক্ত। এটি ব্রণ কমিয়ে ত্বক পরিষ্কার করে।কখন ব্যবহার করবেন?
মুখ, বুক বা কাঁধে গভীর, দাগ ফেলা ব্রণের জন্য ব্যবহার করুন।⏰ ডোজ:
৩০সি পাওয়ার দিনে একবার, ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে। -
🧴 সিলিসিয়া – পুঁজ ভরা ব্রণ যা দেরিতে সারে
সিলিসিয়া পুঁজ ভরা ব্রণের জন্য, যা সহজে সারে না। ব্রণ থেকে পুঁজ বের হয় এবং দাগ থেকে যায়। যারা ঠান্ডায় অস্বস্তি বোধ করে এবং ঘামে বেশি, তাদের জন্য ভালো। এটি পুঁজ বের করে ব্রণ সারায়।কখন ব্যবহার করবেন?
পুঁজ ভরা, দীর্ঘস্থায়ী ব্রণ যা সহজে সারে না, তখন ব্যবহার করুন।⏰ ডোজ:
৬সি বা ৩০সি পাওয়ার দিনে দুইবার, ডাক্তারের পরামর্শে। -
🧴 নাক্স ভমিকা – খাবারের কারণে ব্রণ
তৈলাক্ত বা মশলাদার খাবার, অ্যালকোহল বা কফির কারণে ব্রণ হলে নাক্স ভমিকা ভালো। ব্রণ লাল, জ্বালাপোড়া করে এবং পেটের সমস্যার সাথে থাকে। যারা রাগী বা অধৈর্য, তাদের জন্য উপযুক্ত।কখন ব্যবহার করবেন?
খাবারের কারণে ব্রণ, বিশেষ করে পেটের সমস্যার সাথে, তখন ব্যবহার করুন।⏰ ডোজ:
৩০সি পাওয়ার দিনে একবার বা দুইবার, ডাক্তারের পরামর্শে। -
🧴 ক্যালকেরিয়া সালফ – হলুদ পুঁজ ভরা ব্রণ
হলুদ পুঁজ ভরা ব্রণের জন্য এটি ভালো। ব্রণ থেকে পুঁজ বের হয় এবং দীর্ঘদিন থাকে। ত্বক তৈলাক্ত এবং গরমে খারাপ হয়। এটি ব্রণ শুকিয়ে ত্বক পরিষ্কার করে।কখন ব্যবহার করবেন?
হলুদ পুঁজ ভরা, দীর্ঘস্থায়ী ব্রণের জন্য ব্যবহার করুন।⏰ ডোজ:
৩০সি পাওয়ার দিনে দুইবার, ডাক্তারের পরামর্শে। -
🧴 ন্যাট্রাম মিউর – কপাল ও চিবুকের ব্রণ
কপাল, চিবুক বা নাকের চারপাশে তৈলাক্ত ত্বকে ব্রণ হলে ন্যাট্রাম মিউর ভালো। ব্রণ ছোট, লাল এবং তৈলাক্ত খাবারে বাড়ে। যারা দুঃখী বা হতাশ, তাদের জন্য উপযুক্ত।কখন ব্যবহার করবেন?
কপাল বা চিবুকে তৈলাক্ত ত্বকের ব্রণের জন্য ব্যবহার করুন।⏰ ডোজ:
৩০সি পাওয়ার দিনে দুইবার, ডাক্তারের পরামর্শে। -
🧴 বেলাডোনা – লাল, প্রদাহযুক্ত ব্রণ
হঠাৎ লাল, গরম এবং প্রদাহযুক্ত ব্রণ হলে বেলাডোনা ভালো। ব্রণ স্পর্শে বেদনাদায় commonplace। যারা গরমে অস্বস্তি বোধ করে, তাদের জন্য উপযুক্ত। এটি প্রদাহ কমায়।কখন ব্যবহার করবেন?
লাল, গরম এবং প্রদাহযুক্ত ব্রণের জন্য ব্যবহার করুন।⏰ ডোজ:
৩০সি পাওয়ার দিনে দুইবার, ডাক্তারের পরামর্শে। -
🧴 অ্যান্টিমোনিয়াম ক্রুডাম – শক্ত, বড় ব্রণ
মুখ, পিঠ বা বুকে শক্ত, বড় এবং বেদনাদায়ক ব্রণ হলে এটি ভালো। তৈলাক্ত বা ভারী খাবারে ব্রণ বাড়ে। যারা অতিরিক্ত খায় বা পেটের সমস্যা আছে, তাদের জন্য উপযুক্ত।
কখন ব্যবহার করবেন?
শক্ত, বড় এবং খাবারের কারণে ব্রণ হলে ব্যবহার করুন।
⏰ ডোজ:
৩০সি পাওয়ার দিনে একবার, ডাক্তারের পরামর্শে।
সাধারণ পরামর্শ
- খাবার: দুধ, চিনি, তৈলাক্ত বা ফাস্ট ফুড কম খান। ফল, শাকসবজি এবং পানি বেশি খান।
- ত্বকের যত্ন: ত্বক হালকা সাবান বা ফেসওয়াশ দিয়ে দিনে দুইবার পরিষ্কার করুন। তৈলাক্ত মেকআপ ব্যবহার করবেন না।
- পানি: দিনে ৮-১০ গ্লাস পানি পান করুন।
- মানসিক চাপ: স্ট্রেস কমাতে যোগব্যায়াম বা ধ্যান করুন।
- ঘুম: প্রতিদিন ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমান।
- হাত দিয়ে ব্রণ ছোঁবেন না: এতে সংক্রমণ বাড়তে পারে।
- হোমিওপ্যাথি ডাক্তার: ওষুধ শুরু করার আগে হোমিওপ্যাথি ডাক্তারের পরামর্শ নিন, কারণ প্রত্যেকের লক্ষণ আলাদা।
- ধৈর্য: হোমিওপ্যাথি ধীরে ধীরে কাজ করে, তাই ধৈর্য ধরুন।
সতর্কতা: ওষুধের ডোজ বা পাওয়ার বাড়ানোর আগে ডাক্তারের সাথে কথা বলুন। গুরুতর ব্রণ হলে ত্বকের ডাক্তারের পরামর্শ নিন।